অনলাইন ডেস্ক, ২৮ মার্চ।। ইউক্রেন যুদ্ধের একমাস পেরিয়ে আজ ৩৩তম দিনে গড়িয়েছে। যদিও সেই যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায় নি রাশিয়া, কিন্তু রাশিয়ার গুপ্তঘাতকরা দেশ জুড়ে কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করেছে, সেই সন্দেহ ইউক্রেনের বাসিন্দাদের মধ্যে জোরালো হয়ে উঠেছে। যদিও গোয়েন্দা তথ্যে প্রায়শ এসব বিষয় উঠে আসছে, গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটছে, কিন্তু এই সন্দেহের কতটুকু বাস্তবতা আছে? ইউক্রেনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রহস্যময় লাল বাতি আর তীর চিহ্নের কথা ছড়িয়ে পড়ছে, তারই বা ভিত্তি কতটা আছে?
‘আমার প্রতিবেশীরা কয়েকদিন আগে এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমার বাসায় এসেছিলেন। তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন,’ বিবিসিকে বলছিলেন ২২ বছর বয়সী প্রকৌশলী বোহডান মিলকো। ওডেসার উপকণ্ঠে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে বসবাস করেন তিনি।
ওই ঘটনার ১৫ মিনিট পরেই পুলিশ এসে তার দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। তারা জানতে চায়, বোহডান জানালায় কোন লাল বাতি জ্বালিয়েছিলেন কিনা।
‘রাশিয়ানদের জন্য লাল বাতি হচ্ছে একটা সংকেত বিশেষ, এরকম একটি খবর ছড়িয়ে পড়ার কারণে তাদের মধ্যে অকারণ ভীতি তৈরি হয়েছিল। আমাকে তখন পুলিশ স্টেশনে যেতে হয় এবং আমার কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয়। সেখানে আমার লিখিত বক্তব্য এবং ছবি তুলে রাখা হয়,’ বলছিলেন মিলকো।
তিনি তার বাসায় ঘর সাজানোর কিছু রঙ্গিন বাতি বিবিসির সংবাদদাতাকে দেখান, যা দেখেই তাকে পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল।
‘পুলিশ বলতে পারে, আমি সাধারণ একজন ব্যক্তি এবং আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি রাশিয়ানদের সহায়তা করতে কোন কাজ করিনি,’ তিনি বলছেন।
তার সঙ্গে কথা শেষ করে বিবিসির দলটি যখন ফিরছিল, একটি সড়কে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা তাদের পথরোধ করে। তারা কাগজপত্র দেখতে চায়।
‘আপনারা রাশিয়ার লোকজন হতে পারেন,’ ভালয়া নামের একজন বয়স্ক নারী মন্তব্য করেন।
‘আপনারা এখানে কি করছেন? আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে। তাদের কিছু হোক, আমরা চাই না। হয়তো আগামীকাল আমাদের এখানে কেউ একজন একটা বোমা রেখে যাবে,’ বলছিলেন আরেকজন নারী।
যখন এই আলাপ চলছিল, তখন অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ওপরে বিমান হামলার সতর্কীকরণ সাইরেন বাজতে শুরু করেছে। রাশিয়ার হামলার মধ্যে থাকা ইউক্রেনের নানা শহর এবং পুরো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই উদ্বেগের কারণ বোঝা তেমন কঠিন নয়।
সিরিয়া যুদ্ধ থেকে চেচনিয়ার যুদ্ধ- অনেক যুদ্ধেই এরকম চিত্র দেখা গেছে।
‘একে অকারণ ভীতি বলা যায় না। পুরো ইউক্রেন জুড়েই রাশিয়ার এজেন্ট এবং নাগরিকরা আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। এটাই বাস্তবতা,’ বলেছেন ওডেসা শহরের পুলিশ ক্যাপ্টেন ভলোদামির কালিনা।
কিন্তু তিনি এটাও স্বীকার করেন, এখন অনেক বিভ্রান্তিও ছড়ানো হচ্ছে। জনগণের মধ্যে এরকম অকারণ ভীতি আর বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য তিনি রাশিয়াকেই দায়ী করেন।
‘তারা আমাদের বিভ্রান্ত করতে চায়, যাতে ভুল জায়গায় আমাদের মনোযোগ চলে যায়। শহরের কোন একদিকে আমাদের টেনে নিয়ে যেতে চায়, যাতে অন্য আরেক জায়গায় তাদের কর্মকাণ্ড চালাতে পারে,’ তিনি বলছেন।
ওডেসা শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে আরেকটি এলাকা রয়েছে, যেখানকার সমুদ্র সৈকতের পাশে নাইটক্লাব আর বারের জন্য খ্যাতি রয়েছে, সেখানে ব্যবসা থেকে অবসর নেয়া ৭১ বছর বয়সী দিমিত্রো নোভাক প্রতিদিন সকাল শুরু করেন আশেপাশের এলাকায় টহলের মধ্য দিয়ে।
তিনি একটি দেয়ালে আঁকা একটি তীর চিহ্ন দেখালেন। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, এটা তিনি ঢেকে দিয়েছেন, কারণ এটা হয়তো রাশিয়ানদের জন্য একটি সংকেত হতে পারে।
কয়েক মিনিট পরে তিনি বিশাল একটি এলাকায় দাঁড়ালেন, যেখানে সমুদ্রের দিকে মুখ করা অসংখ্য খালি ভবন পড়ে রয়েছে।
‘আমি ওখানে একটা বড় আকারে বাতি জ্বলতে দেখেছি। এটা রাতের আকাশের দিকে তাক করা ছিল। আমার প্রতিবেশীরা সেটা দেখতে পেয়েছে। একটা ভবনের ছাদে বাতিটা জ্বলছিল। আমি নিশ্চিত, এটা ছিল রাশিয়ার নৌবাহিনীর জন্য কোন এক ধরনের সংকেত,’ তিনি বলছেন।
‘আমরা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি, তারা সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। তখন বাতিটা বন্ধ হয়ে যায়। অন্য কোন সংকেত বা চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা, এখন আমরা সতর্কতার সঙ্গে সেটার খোঁজ করছি। সবাই সতর্ক রয়েছে, প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর পালা বদল করে আমরা নজর রাখছি,’ তিনি বলছেন।
গত রাতে রাশিয়ার নৌ বাহিনী ওই এলাকায় গোলাবর্ষণ করে। কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র সৈকতের কাছেই পড়ে, আবাসিক এলাকার অনেকগুলো ভবন বিধ্বস্ত হয়। তবে হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেনি।
ড. হান্না শ্যালেত ইউক্রেনের পার্লামেন্টে নিরাপত্তা বিষয়ক একজন পরামর্শক হিসাবে কাজ করেন। তিনিও আশঙ্কার কথা জানান যে, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য তথ্য সরবরাহের কাজ করছে অনেক ইউক্রেনিয়ান বা রাশিয়ান।
‘তাদের প্রথম লক্ষ্য হলো শহরের মধ্যে অস্ত্র আর গোলাবারুদের মজুদ গড়ে তোলা। শহরের পথেঘাটে যদি লড়াই শুরু হয়ে যায়, তখন এগুলো কাজে লাগাবে। আর দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো গুজব আর ভুল তথ্য ছড়ানো,’ তিনি বলছেন।
‘তাদের তৃতীয় লক্ষ্য হলো, রাশিয়ান বাহিনী যদি শহরে নেমেই পড়ে, তাদের কোনদিকে যেতে হবে, সেসব নিশানা দিয়ে দেয়া। আর চতুর্থ হচ্ছে, কোথায় কোথায় তাদের হামলা চালাতে হবে, সেসব লক্ষ্য চিহ্নিত করে দেয়া-সেটা সরাসরি বা ইলেকট্রনিক যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন- যাতে গোলন্দাজ বাহিনী বা বিমান থেকে হামলা চালানো যায়,’ বলছেন হান্না শ্যালেত।
ইউক্রেনের গণমাধ্যমে একাধিক ভিডিও সম্প্রচার করা হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে, সন্দেহভাজন চোরাগোপ্তা হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনের পুলিশ।
রাশিয়ার গুপ্ত হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করার পুরস্কার হিসাবে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পুলিশ সদস্যদের পদক দিচ্ছেন, এমন ভিডিও প্রচারিত হয়েছে।
কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে, যতটা ভীতি এবং সন্দেহের কথা প্রচারিত হচ্ছে, বাস্তবে যেসব তথ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে পরিষ্কার যে রাশিয়ার গোপন হামলাকারী সেলের সফলতার হার খুবই কম।
রাশিয়া যতই প্রচারণা চালাচ্ছে না কেন, ক্রেমলিনের হামলার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের জনগণ একতাবদ্ধ রয়েছে।
‘ফিফথ কলাম’ নামে গুপ্ত হামলাকারীদের সেল রাশিয়ায় কার্যকর রয়েছে বলে যেসব খবর বলা হয়, বাস্তবে সেটি পুরোপুরি কল্পনাপ্রসূত বলেই মনে করা হচ্ছে।‘সন্দেহভাজন সবাইকে কড়া নজরদারির মধ্যে রেখেছে ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনী। আমরা জানি, বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখনো তাদের সফল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই তৈরি হয়নি,’ বলছেন ড. হান্না শ্যালেত।