আগরতলা, ২১ ফেব্রুয়ারী।। মাতৃভাষা হল নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। মাতৃভাষা মানুষকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে। নিজস্ব সংস্কৃতির সংরক্ষণে মাতৃভাষা হচ্ছে অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। আজ আগরতলা টাউন হলে বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তর ও আগরতলাস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রাজ্যভিত্তিক কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর (ডাঃ) মানিক সাহা একথা বলেন।
তিনি বলেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের উপর জোর করে উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ভাষা আন্দোলনে শহিদ হয়েছিলেন সালাম, বরকত, জব্বররা। তাই এই দিনটি ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হল সকল জাতির মাতৃভাষাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া এবং সকল ভাষার প্রতি সমান মর্যাদা প্রদর্শন করা। এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল ভাবনা হচ্ছে: ‘বহুভাষিক শিক্ষা আন্তঃপ্রজন্মীয় শিখনের ভিত্তি’। এই ভাবনাটি ইতিমধ্যেই আমাদের দেশের ২০২০ সালের নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতিতে স্থান করে নিয়েছে।
অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, মাতৃভাষা হচ্ছে মাতৃদুগ্ধের সমান। মা থেকে যে ভাষাটা প্রথম শেখা হয় সেটাই আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা মানুষের হৃদয়ের ভাষা। নিজের মাতৃভাষা রক্ষা করার পাশাপাশি অন্যের ভাষাকেও সমান মর্যাদা দেওয়া সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মর্যাদা পাওয়া শুধু বাংলা ভাষার বিশ্ব জয় নয়, সমস্ত মাতৃভাষারই বিজয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরা রাজ্য একটি বহুভাষিক রাজ্য। ককবরক সহ অন্যান্য ৮টি ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়ে নির্বাচিত বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ত্রিপুরায় বর্তমানে ১২৯৬টি বুনিয়াদি, ১১৫ মাধ্যমিক এবং ৬৫টি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ককবরক ভাষাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে চালু করা হয়েছে।
তাছাড়াও অন্যান্য জনজাতি গোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষাগুলির উন্নতিসাধনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে চাকমা, মনিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী, কুকি-মিজো, হালাম, মগ ও গারো অন্যতম। বর্তমানে ১২৩টি বিদ্যালয়ে চাকমা ভাষা, ২৪টি বিদ্যালয়ে মনিপুরী ভাষা, ৩৯টি বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষা, ৯০টি বিদ্যালয়ে হালাম ভাষা, ১৫টি বিদ্যালয়ে কুকি-মিজো ভাষা, ৩৭টি বিদ্যালয়ে মগ ভাষা এবং ১৩টি বিদ্যালয়ে গারো ভাষা চালু করা হয়েছে। তিনি বলেন, ককবরক সহ মোট ৮টি ভাষাতে প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজ্যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৮টি জনজাতি গোষ্ঠীর মাতৃভাষার উন্নয়নে রাজ্যস্তরে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। জনজাতি গোষ্ঠীর ভাষার বিকাশে সরকার কাজ করছে।
অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্য সরকার টেট পরীক্ষায় ককবরক ভাষা চালু করেছে। তাছাড়া ত্রিপুরা জুডিশিয়াল সার্ভিসেও ককবরক ভাষায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ককবরক সহ অন্যান্য ভাষার বিকাশ ও মর্যাদা প্রদানে রাজ্য সরকার বদ্ধপরিকর।
অনুষ্ঠানের সভাপতি শিক্ষা দপ্তরের বিশেষ সচিব রাভাল হেমেন্দ্র কুমার বলেন, নিজের ভাষার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষাও শেখা প্রয়োজন। এরফলে চেতনার বিকাশ ঘটে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এবারের ভাবনা একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ।
অনুষ্ঠানে আগরতলাস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের সহকারী হাইকমিশনার আরিফ মোহাম্মদ বলেন, আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা গ্রহণ করতে পারবেন। তারা হারিয়ে যাওয়া ভাষাগুলির পুনরুদ্ধারেও উদ্যোগ নিতে পারবেন। তিনি বলেন, আমাদের সন্তানরা যদি বহু ভাষা শিক্ষাদানে সজাগ ও তৎপর হয় তাহলে সমাজে বিরাজমান বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মধ্যশিক্ষা অধিকারের অধিকর্তা এন সি শর্মা।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের অধিকর্তা বিম্বিসার ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে অমর একুশে ভাষা শহীদদের তাৎপর্য নিয়ে একটি তথ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে রাজ্যের বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর জাতি জনজাতিদের প্রতিনিধিগণ তাদের চিরাচরিত পোশাক পরিধান করে নিজস্ব ভাষায় উপস্থিত সকলকে অভিবাদন জানান। অনুষ্ঠানের শুরুতে মুখ্যমন্ত্রী সহ আতিথিগণ শহীদ বেদীতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেন।