আগরতলা, ১ মার্চ।। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য আজ রাজ্য বিধানসভায় ২৭ হাজার ৮০৪ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী প্রণজিৎ সিংহ রায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ব্যয় বরাদ্দের যে প্রস্তাব পেশ করেছেন তাতে মূলধনী ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৬৩৩ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা যা ২০২৩-২৪ বছরের রিভাইসড এস্টিমেটের চাইতে ২৪.২৬ শতাংশ বেশি। বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৪১০ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকা। বাজেট প্রস্তাবে মোট আয় দেখানো হয়েছে ২৭ হাজার ৩৯৩ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকা। বাজেটে নতুন করে কোন করারোপ করা হয়নি।
বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ ধরা হয়েছে শিক্ষা (প্রাথমিক, বিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও সমাজশিক্ষা, ককবরক এবং যুব কল্যাণ ও ক্রীড়া) দপ্তরের জন্য। এই দপ্তরের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৫৫০৮.৬৩ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ১৯৮১ শতাংশ। পূর্ত দপ্তরের (সড়ক ও সেতু, পানীয়জল ও স্বাস্থ্যবিধি এবং জল সম্পদ) জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৩০৭০.৬৩ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ১১.০৪ শতাংশ। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২৩৫৭.০১ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ৮.৪৮ শতাংশ। পঞ্চায়েত সহ গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২২১৭.৯২ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ৭.৯৮ শতাংশ। বাজেট প্রস্তাব পেশ করে অর্থমন্ত্রী প্রণজিৎ সিংহ রায় আজ দুপুরে বিধানসভার প্রেস কর্ণারে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই বাজেটকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভবিষ্যৎমুখী ও বিকাশমুখী হিসাবে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, সমাজের প্রতিটি অংশের মানুষের জন্য এই বাজেটে কিছু না কিছু রয়েছে। তিনি বলেন, রাজ্যের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে রাজ্যের জিএসডিপি’র বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৪৯ শতাংশ যা জাতীয়স্তরে ছিল ৭.২০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজ্যের অর্থনীতি ৮.৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই সময়ে জাতীয় পর্যায়ে এই হার ৭.৩ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে জিএসডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.৪৭ শতাংশ হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী প্রণজিৎ সিংহ রায় জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে রাজ্যের নিজস্ব রাজস্ব কর ৩ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা অনুমান করা হয়েছে। রাজ্যের নিজস্ব নন ট্যাক্স রাজস্ব আনুমানিক ৪৭৫ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। তিনি জানান, উত্তর ত্রিপুরার যুবরাজনগরে এবং পশ্চিম ত্রিপুরার পুরাতন আগরতলায় ২টি নতুন কৃষি মহকুমা খোলা হবে। অরুন্ধতীনগর রাজ্য কৃষি গবেষণাকেন্দ্রে মোট ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১টি ‘শাকসব্জির অবশিষ্টাংশ পরীক্ষাগার’ এবং ১টি ‘জার্ম প্লাজম সংরক্ষণ’ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। ২০২৪- ২৫ অর্থবর্ষে ৮টি নতুন কৃষি উন্নয়ন গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলা হবে, মোট ২৩ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে।
তৈদুতে ইন্দো-ডাচ প্রকল্পের আওতায় ৯ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১টি লেবুজাতীয় ফলের ‘এক্সিলেন্স সেন্টার’ এবং লেম্বুছড়াতে ইন্দো-ইজরায়েল অ্যাকশন পরিকল্পনার আওতায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১টি ফুলের এক্সিলেন্স সেন্টার গড়ে তুলে রাজ্যে ফল, শাকসব্জি ও ফুলের বৈজ্ঞানিক চাষ এবং সর্বোত্তম মানের রোপণ সামগ্রী সরবরাহের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী জানান, মোট ১৭ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৪টি মৎস্যচাষ জ্ঞান কেন্দ্র এবং ১টি রাজ্য মৎস্য সচেতনতা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। আরআইডিএফ’র প্রদত্ত ঋণে ২১টি মাধ্যমিকস্তরের বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ১২৩ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে উদয়পুরে মাতা ত্রিপুরাসুন্দরী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। পিএম-ডিভাইনের আওতায় মোট ১৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে আগরতলা এজিএমসি এবং জিবিপি হাসপাতাল পরিসরে ২০০ শয্যা বিশিষ্ট মাল্টিকেয়ার স্বাস্থ্য ইউনিট নির্মাণ করা হবে। তপশিলী জাতির ৪০০ জন শিক্ষার্থীকে ১ লক্ষ টাকা করে এককালীন আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এরজন্য ব্যয় হবে ৪ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী জনবিকাশ কার্যক্রমের’ আওতায় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রামে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ‘মুখ্যমন্ত্রী সামাজিক সহায়ক প্রকল্পের’ আওতায় আরও ২৯ হাজার ৪১০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং এরজন্য বার্ষিক অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা করা হবে ৭০ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা।
তিনি জানান, ভারত সরকারের ‘মিশন শক্তির’ আওতায় অসহায় মহিলাদের জন্য মাতাবাড়ি ও তেলিয়ামুড়ায় ২টি ‘শক্তি সদন’ স্থাপন করা হবে ১০ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা বায়ে। যেসব জনবসতিগুলিতে আদিম ও প্রান্তিক জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন সেখানে ৭৭টি নতুন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র (এডব্লিউসি) ৯ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হবে। মোট ৩৭ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় রাবার শিট প্রক্রিয়াকরণের জন্য ৫০টি স্মোক হাউস নির্মাণ করা হবে। ৭৬ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে জনজাতি ছাত্রীদের জন্য ১১টি এবং জনজাতি ছাত্রদের জন্য ১০টি ৫০ আসন বিশিষ্ট হোস্টেল নির্মাণ করা হবে। তীর্থমুখ মেলা প্রাঙ্গণে ১৫ কোটি ১১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার সর্বমোট ৬৯৮ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা টিটিএএডিসি’কে সরাসরি প্রদান করবে।
এই পরিমাণ তহবিল টিটিএএডিসি এলাকার গ্রাম পরিষদগুলির জন্য ৫ম রাজ্য আর্থকমিশনের অধীনে করের অংশ থেকে হস্তান্তরিত তহবিলের অতিরিক্ত। এছাড়াও রাজ্য সরকার জনজাতি ভাই বোনেদের কল্যাণে মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ৩৯.৯৩ শতাংশ ধার্য করেছে। ২০২৪-২৫ সালে রাজ্য সরকার ৭ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সমস্ত বিডিওদের নতুন গাড়ি সরবরাহ করবে। বর্তমানে যেখানে আবাসন নেই সেইসব জায়গায় সমস্ত বিডিও, অ্যাডিশনাল বিডিও ও এডিএমদের জন্য আবাসন নির্মাণ করা হবে। রাজ্য সরকার স্বচ্ছতার উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০২৪-২৫ সাল থেকে শুধুমাত্র স্বচ্ছতার জন্য নতুন ডিমান্ড খোলা হয়েছে, বরাদ্দ করা হয়েছে ১৩৯ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা।
অর্থমন্ত্রী জানান, রাজ্য সরকার স্বামিত্ব প্রকল্পের আওতায় সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সহযোগিতায় বিদ্যমান রাজস্ব মানচিত্র হালনাগাদ করার জন্য জমির জরিপ করবে। একটি ‘ভূমি ব্যাঙ্ক’ চালু করা হবে, যার অধীনে অব্যবহৃত সরকারি জমির উন্নীতকরণ হবে। তারপর সেই উন্নীত জমি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে লিজ দেওয়া হবে। প্রয়োজনে সরকারি জমির আশেপাশে থাকা বেসরকারি জোত জমিও ক্রয় করা হবে এবং সেই জমি সরকারি জমির মত করেই উন্নীতকরণ করা হবে। এই যোজনা বাস্তবায়নের জন্য ১০ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে ৩০ কিলোমিটার রাস্তার পুনর্বিন্যাসের জন্য ৬০টি বিধানসভা কেন্দ্র জুড়ে সড়ক পরিকাঠামোগত কাজের জন্য পরবর্তী ৪ বছরের সময়কালে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। ৮টি ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প নির্মাণ করা হবে। ১১টি লিফট ইরিগেশন স্কিম ও ১৮৩টি ডিপটিউবওয়েল স্থাপন করা হবে। এটি ১১০ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে অতিরিক্ত ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি চাষের আওতায় আনবে। নাবার্ড তহবিল থেকে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নদীর তীরে ভূমিক্ষয় প্রতিরোধক ব্যবস্থা তৈরির কাজের জন্য ১০০ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হবে। ‘পিএম-জনমন’-এর আওতায় ৬৯ কোটি ১২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে আদিম ও প্রান্তিক জনজাতি গোষ্ঠীর বসবাসকারী সমস্ত বসতিতে বিদ্যুতায়ন করা হবে। নারী ও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট তৈরি করতে বিভিন্ন শহরে ৮৫টি ‘পিঙ্ক টয়লেট’ নির্মাণ করা হবে, মোট ৭ কোটি ৫১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে।