পুরাতন হাবেলির প্রান্তরে বইছে খার্চি উৎসবের আগমনী আনন্দধারা

।। নীতা সরকার ।। আগরতলা, ২৫ জুন।। বছর ঘুরে আবারও রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী মহামিলনের উৎসব খার্চি আমাদের তথা সমগ্র ত্রিপুরাবাসীর ঘরে ঘরে আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসছে৷ ২৬ জুন থেকে পুরাতন হাবেলির প্রান্তর জুড়ে বইছে খার্চি উৎসবের আগমনী আনন্দধারা। আষাঢ় মাসের শুক্লাষ্টমী তিথি বা বর্ষাকাল এলেই আমাদের মনে পড়ে খার্চি উৎসব ও মেলার কথা।

গ্রীষ্মের প্রখর তীব্রতা সরিয়ে একদিকে প্রকৃতি যেমন বৃষ্টিস্নাত হয়ে উঠে, দিকে দিকে গাছে গাছে সবুজের স্নিগ্ধতা বিরাজ করে, তেমনি ত্রিপুরার ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে জাতি জনজাতির মানুষ খাটি উৎসবে মেতে উঠেন। প্রকৃতির সাজ সাজ রবের সাথে পুরাতন আগরতলা চতুর্দশ দেবতার মন্দির ও মন্দির প্রাঙ্গণও নবরূপে সেজে উঠতে থাকে। প্রতিদিন রোদ বৃষ্টির মাঝেই প্রতিবছর খার্চি উৎসবের প্রস্তুতি চলতে থাকে।

এবছরও তাই চলছে। পূর্ত দপ্তরের কর্মীগণ চতুর্দশ দেবতার মন্দির সংস্কার করে নতুন রঙের প্রলেপ দিচ্ছে। খার্চি উৎসবে আগত অগণিত পুণ্যার্থীদের সুষ্ঠু পরিষেবার দিকে লক্ষ্য রেখে মন্দির নগরীর পার্শ্ববর্তী নালা, নর্দমা, জলাশয়, যাতায়াতের পথ সবকিছুই নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। মেলার মাঠকে সংস্কার করে মেলায় ব্যবসা বাণিজ্য করতে আসা ছোট বড় ব্যবসায়ীদের জন্য স্টল তৈরি করা হয়েছে। এবছর প্রায় ৮০০ স্টল তৈরি হয়েছে। ২২টি স্টল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের উন্নয়ন কর্মসূচির প্রদর্শনীর জন্য। চতুর্দশ দেবতার স্নান ঘাট সহ চতুর্দশ দেবতা বাড়ি প্রাঙ্গণ থেকে স্নান ঘাট পর্যন্ত রাস্তাও সংস্কার করা হয়েছে।

হাবেলি মিউজিয়াম, হাবেলি মুক্তমঞ্চ, কৃষ্ণমালা মঞ্চ, শিশু পার্ক নানা রঙে সাজানো হচ্ছে। পানীয়জল ও স্বাস্থ্যবিধান দপ্তর পুণ্যার্থীদের পরিশ্রুত পানীয়জল সরবরাহের লক্ষ্যে পানীয়জনের উৎসগুলিকে নতুনভাবে পরিচ্ছন্ন করে তুলেছে। পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখার জন্য আরক্ষা দপ্তর মেলা প্রাঙ্গণের চতুর্দিকে ২৮টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছে। বিদ্যুৎ নিগম আলোর মালায় চতুর্দশ দেবতার মন্দির সহ পুরো মন্দির এলাকা রাস্তাঘাট, জলাশয়ের চারপাশ সাজিয়ে তুলেছে।

অগ্নি নির্বাপক দপ্তর, রাজ্য এনডিআরএফের টিম, টিএসআর বাহিনী, স্কাউটস অ্যান্ড গাইডস, স্বাস্থ্য দপ্তর, পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা প্রশাসন সহ সমস্ত সরকারি বেসরকারি সংস্থা খার্চি উৎসবকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে। ৭ দিনব্যাপী খাটি উৎসবকে সফল রূপ দেওয়ার জন্য বিধায়ক রতন চক্রবর্তীকে চেয়ারম্যান এবং পুরাতন আগরতলা পঞ্চায়েত সমিতির চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ শীলকে ভাইস চেয়ারম্যান করে ৫৯ জন সদস্যের কার্যকরী কমিটি এবং ১৩টি সাব কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সকলেই এই খাটি উৎসবকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করছেন। এই সবকিছুর প্রস্তুতির চূড়ান্ত পর্যায়ের পরিসরে সুস্থ সংস্কৃতির বার্তা নিয়ে আসবে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর। ছোট্ট পার্বত্য ত্রিপুরাকে মূলত একটি মিশ্র সংস্কৃতির রাজ্য বলা যেতে পারে। এখানে ১৯টি আদিবাসী ভাষা কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে বাঙ্গালি ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এক মৈত্রী সেতু তৈরি হয়েছে। খার্চি উৎসবের সময় এই মিশ্র সাংস্কৃতিক বোধ বা চেতনা মানুষের মেলবন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করে তুলে।

খাটি শব্দটি উচ্চারিত হলেই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে একটি অসাধারণ মেলবন্ধন ও সম্প্রীতির ছবি। এই মিশ্র সাংস্কৃতিক বোধ ও সম্প্রীতির ছবি আরও অপূর্ব রূপে প্রকাশ পায় হাবেলির মুক্তমঞ্চে ও কৃষ্ণমালা মঞ্চে। তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর এবং খাটি মেলা আয়োজক কমিটির যৌথ উদ্যোগে মেলার ৭দিন এই মঞ্চগুলি থেকে বয়ে চলে নানা সংস্কৃতির সুরের মূর্ছনা। সাংস্কৃতিক বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে এই মঞ্চ দুটি ভরে উঠে। প্রতি বছরের মতো এবছরও এই মঞ্চ দুটিতে নানা সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ এই খাটির ৭দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এর প্রস্তুতি পর্বও প্রায় চূড়ান্ত। দুটি মঞ্চে প্রতিদিন ৩টি পর্যায়ে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে।

সকাল ১১টা থেকে কৃষ্ণমালা মঞ্চে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে আগত শিল্পীগণ বিচিত্রা অনুষ্ঠান, জনজাতি লোকনৃত্য, সংগীত, মঙ্গলকাব্য পাঠ, আদিবাসী বাউল সংগীত, সমবেত নৃত্য ও সংগীত, আবৃত্তি, পালা কীর্তন ইত্যাদি পরিবেশন করবেন। বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হাবেলি মুক্তমঞ্চে প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হবে শিশু উৎসব। এখানে রাজের শিশু শিল্পীগণ সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি পরিবেশন করবে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে কৃষ্ণমালা মঞ্চে পরিবেশিত হবে বিভিন্ন রাজ্য ও বহির্রাজ্যের সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পীদের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। খার্চি পূজা ও উৎসব আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। যা শেষ হয়েও শেষ হয় না। প্রতিনিয়ত জেগে থাকে নতুনের প্রতীক্ষায়।

You May Also Like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *