রাশিয়ার সামরিক অভিযানের অভিঘাত এসে পড়েছে রাশিয়ানদের জীবনেও

অনলাইন ডেস্ক, ২৩ এপ্রিল।। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের অভিঘাত এসে পড়েছে রাশিয়ানদের জীবনেও। যদিও মস্কোতে কোনো গোলা এসে পড়ে না, বা অন্য কোনো দেশের সৈন্যরা শহরবাসীকে অবরোধ করে নেই।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করার পর বদলে যাওয়া রাশিয়ানদের জীবনযাপনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ইউক্রেনের মানুষ যে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তার ছিটেফোঁটাও মস্কোর লোকজনকে সহ্য করতে হচ্ছে না।
তবে যুদ্ধের অভিঘাতে রাশিয়ানদের বদলে যেতে হয়েছে।
মস্কো থেকে বিবিসি নিউজের স্টিভ রোজেনবার্গ জানান, সাদা চোখে প্রথম দেখলে মনে হবে সবকিছুই স্বাভাবিক। নিত্যদিনের মতো মস্কোর রোজ গার্ডেন রিং সড়কে যানজট। আমার ঠিক সামনে পাতাল রেল স্টেশন থেকে পিলপিল করে লোক বেরুচ্ছে। কিন্তু, বাস্তবে দুই মাস আগের তুলনায় এই শহরের কোনো কিছুকেই এখন আর স্বাভাবিক বলা যাবেনা।

তার মতে, রাশিয়ায় স্বাভাবিক জীবন শেষ হয়ে গেছে ২৪শে ফেব্রুয়ারি – যেদিন ভ্লাদিমির পুতিন তার সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর নির্দেশ দেন।

তিনি বলেন, কম্যুনিস্ট রাশিয়াকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর রাশিয়া যে পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে তাও আমি ভেতরে বসে দেখেছি। এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই দেশটি আবার বদলাতে শুরু করেছে।

‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নিয়ে রাশিয়ার ভেতর কী চলছে তা জানাতে গিয়ে স্টিভ রোজেনবার্গ বলেন, আমি একটি সুপারমার্কেটে যাওয়ার জন্য গাড়িতে চাপলাম। অভ্যাসবশত গাড়ির রেডিও ছাড়লাম। রেডিও টিউন করা রয়েছে ৯১.২ এফএম-এ। একসময় এটি ছিল ‘রেডিও একো অব মস্কো’র তরঙ্গ – আমার সবচেয়ে প্রিয় রেডিও স্টেশন, যেখান থেকে নির্ভরযোগ্য খবর পাওয়া যায়। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ায় সব স্বাধীন মিডিয়া হয় ব্লক করা হয়েছে না হয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন ৯১.২ এফএমে সরকারি রেডিও স্পুটনিক চলে – যেটি ইউক্রেন রুশ হামলার বড় সমর্থক।

গার্ডেন রিং দিয়ে গাড়ি চালানোর সময়, আমি একটি থিয়েটার হলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম যার গায়ে বিশাল আকারের ‘Z’ (জেড) অক্ষর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে যেটি এখন রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রতীক। রুশ রেলওয়ের সদর দপ্তরের বাইরেও একইরকম একটি Z স্থাপন করা হয়েছে। আমার পাশ দিয়ে একটি ট্রাক চলে গেল যার গায়ে Z লেখা স্টিকার। গত কয়েক সপ্তাহে ক্রেমলিনের সমালোচক বলে পরিচিত এমন বহু লোকজনের বাড়ির দরজায়, পাঁচিলে এই অক্ষর লেখা স্টিকার সেঁটে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, যে শপিং মলে আমি গেলাম, বেচাকেনার ভিড় তেমন নেই। বিদেশী ব্রান্ডের অধিকাংশ দোকান বন্ধ। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর শত শত বিদেশী কোম্পানি রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে।

সুপারমার্কেটে জিনিসের কমতি নেই। সমস্ত তাকই ঠাসা। গত মাসে বাজারে প্যানিক দেখা দেওয়ায় চিনির যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা কেটে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু যত ধরণের জিনিস ক’মাস আগেও দোকানে পাওয়া যেত ততটা এখন পাওয়া যাচ্ছে না। গত দুমাস জিনিসপত্রের দামও বেশ বেড়ে গেছে।

শপিং মলের বাইরে বিবিসির প্রতিবেদকে ডা. নাদেঝদা বলেন, জিনিসপত্রের দাম এতটা বেড়ে গেছে যে আমার বেতনে চলা আর সম্ভব হচ্ছে না। তবে সুপারমার্কেটগুলোতে অনেক ক্রেতা এবং ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর প্রথম দিকে জনমনে যে উদ্বেগ দেখা গিয়েছিল তা যেন আর নেই।

ডা. নাদেঝদা বলেন, কিন্তু ইউক্রেনে আসলে কী হচ্ছে সেই সত্যটি যে সমাজ জানতে চায় না তেমন একটি সমাজে বসবাস খুবই যন্ত্রণার। মানুষ তার বাড়ির মর্টগেজ দেওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন, ব্যাংক লোন শোধ নিয়ে চিন্তিত। তার আশপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে যেন তাদের কোনো চিন্তা নেই। একজন রুশ হিসাবে আমি লজ্জিত।

স্টিভ রোজেনবার্গ বলেন, শপিং মল থেকে আমি মস্কোর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের দিকে রওয়ানা দিলাম যে প্রতিষ্ঠানে ৩০ বছর আগে আমি ইংরেজি পড়াতাম। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে কম্যুনিজমের পতনের পর এখানে আমার ছাত্ররা খুবই আশাবাদী ছিল যে এখন রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এবং সহযোগিতার একটি সম্পর্ক তৈরি হবে। তারা আশা করতো তাদের ভবিষ্যৎ হবে শান্তির এবং সমৃদ্ধির। কিন্ত বাস্তবে তা হয়নি।

ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের ছাত্র ডেনিস বিবিসিকে বলেন, আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠবো। সূর্যাস্তের পর আবারো নতুন একটি সকাল আসবে। কিন্তু আমি আমাদের সৈন্যদের পেছনে রয়েছি। তারা আমাদের সৈনিক। যাই হোক না কেন দেশকে সমর্থন করা আমার দায়িত্ব।

মস্কোতে সেদিন বিবিসির এই প্রতিবেদকের শেষ গন্তব্য ছিল বিশাল সমর যাদুঘর যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় বার্ষিকী উদযাপন শুরু হয়েছে। ওই যুদ্ধে দুই কোটি ৭০ লাখ সোভিয়েত নাগরিক মারা গিয়েছিল। মাতৃভূমির জন্য রুশদের আত্মত্যাগের একটি প্রতীক হিসাবে দেখা হয় ঐ যুদ্ধকে। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’কে যেভাবে এই যাদুঘরে তুলে ধরা হচ্ছে তা নিয়ে আমার অস্বস্তি হয়েছে।

যাদুঘরে ওয়েবসাইটে মিউজিয়াম শব্দটির বানান বদলে এস (s) এর জায়গায় ডেজ (Z) করে দেওয়া হয়েছে। যাদুঘরের ভেতর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কিত সুভ্যেনিরের দোকানে Z লেখা মগ বিক্রি হচ্ছে। ‘পুতিন আমার প্রেসিডেন্ট’ লেখা ব্যাজ বিক্রি হচ্ছে যেখানে প্রেসিডেন্ট শব্দটির বানানে S এর জায়গায় Z লেখা হয়েছে।

শুধু তাই নয় মস্কোর ওই যাদুঘরে এখন ইউক্রেনে নাৎসিদের নিয়ে একটি বিশেষ প্রদর্শনী হচ্ছে। নাৎসিদের হাত থেকে ইউক্রেনকে মুক্ত করার মনগড়া স্লোগান দিয়েই সেদেশে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল রাশিয়া।

ইউক্রেন তাদের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নিয়ে একটি বিকল্প সমান্তরাল আখ্যান রুশ জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে যেখানে আগ্রাসন হচ্ছে মুক্তি সংগ্রাম এবং আত্মরক্ষা, যেখানে সরকারের সমালোচকরা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক।

সবশেষে বিবিসি নিউজের স্টিভ রোজেনবার্গ বলেন, আমার এখন মনে হয় যে রাশিয়াকে আমি ৩০ বছর ধরে চিনি সেই রাশিয়ার এখন অস্তিত্ব নেই।

You May Also Like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *