।।আন্তর্জাতিক নারী দিবস।। এটা কোনো অজানা বিষয় নয় যে মার্চ মাসটি বিশ্বজুড়ে নারীর ইতিহাসের মাস হিসেবে চিহ্নিত যেখানে আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক অর্জনকে স্মরণ করে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মধ্য দিয়ে নারীত্বের উৎসব পালিত হয়। জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে মহিলাদের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য এই দিনটি পালিত হয়। এই দিনে প্রত্যেককে নারী অধিকার, লিঙ্গ সমতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হয়। যদিও সংবিধানে নারী-পুরুষের সম অধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ হচ্ছে না। যৌতুক, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতি অপরাধে শাস্তির বিধান থাকলেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় অপরাধী। সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিয়ে, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব- সব ক্ষেত্রেই আইনের কাঠামোগত দুর্বলতায় নারী হয় বঞ্চিত। দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে যে সন্তানকে সে জন্ম দেয়, বড় করে, সে সন্তানের অভিভাবকত্ব পায় না নারী।
তবে আজকের এই বিশেষ দিনে বিশ্বের এক এক প্রান্তে নারীদিবস উদ্যাপনের প্রধান লক্ষ্য এক এক প্রকার হয়। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদ্যাপনের মুখ্য বিষয় হয়, আবার কোথাও মহিলাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠাটি বেশি গুরুত্ব পায়।
ভারতীয় সমাজের বিবর্তনের ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মূলত পুরুষতান্ত্রিক ভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চালিত হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সমাজে বেশ কিছু নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। মধ্যযুগে সুলতানা রাজিয়া থেকে শুরু করে উনিশ-বিশ শতকে রানি রাসমনি, সারদাদেবী, সাবিত্রী ফুলে, সিস্টার নিবেদিতা, ঠাকুরবাড়ির নানা মহিলা সদস্য— সাহিত্য, ধর্ম, রাজকার্যের মতো ক্ষেত্রে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছিলেন। নারীস্বাধীনতার বিষয়টিকে নিয়ে রাজনীতির ময়দানেও প্রয়াসের খামতি নেই।
মহিলাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে, নির্বাচনে তাঁদের জন্য একটা নির্দিষ্ট শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের বহু প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে বসেছেন মহিলারা। চিকিৎসা থেকে শুরু করে সাহিত্য— সর্বত্র মহিলাদের যোগদানের হার বাড়ছে।
ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাচীনতম ঐতিহ্য সিন্ধু সভ্যতা থেকে পাওয়া বিভিন্ন নিদর্শন থেকে আমরা আদিম ভারতীয় সমাজে নারীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানের কথা জানতে পারি। অন্যদিকে সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাচীনতম লিখিত গ্রন্থ বেদে লোপামুদ্রা, গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রমূখ মহিষী নারীদের কথা পাওয়া যায়। এই সকল নারী আপন যোগ্যতাবলে সমাজে ব্রাহ্মণত্বের সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।
এছাড়া দক্ষিণ ভারতীয় ইতিহাসে শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বারবার ফিরে ফিরে আসে নারীদের ব্যাপক ভূমিকা ও প্রভাবের কথা। তাই একথা মেনে নিতেই হয় সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি সমাজে নারীকে শুধুমাত্র তার লিঙ্গপরিচয়ের মাপকাঠিতে বিচার না করে আপন যোগ্যতা অনুযায়ী তাকে দিয়েছে প্রাপ্য মর্যাদা।
তাই বলা হয়-
” বিশ্বে যা -কিছু মহান সৃষ্টি চির -কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছি নারী ”
বর্তমান সমাজে নারীদের অগ্রগতিতে, লাইট ক্যামেরা আকশান বললে শুধুমাত্র পুরুষ নয় নারীরাও এখন ভেসে ওঠেন তেমনি একটা নাম অপর্না সেন বাংলা চলচ্চিত্রের একটি অতি পরিচিত এবং সমাদৃত একটি মুখ। যিনি একাধারে অভিনেত্রী, ছবি সম্পাদীকা, পরিচালিকা, এবং তাছাড়াও নারী বিষয়ক একটি পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করে আসছেন। তাছাড়াও চলচ্চিত্রের জগতে নারী চরিত্র কে ভিত্তি করে অনেক সিনেমা দেখা গেছে এবং এখনও দেখা যাচ্ছে। পূর্বের নারী জাতির দৃঢ়তা ফুটিয়ে তুলে ধরছে চলচ্চিত্র জগৎ। কখনও ঝাঁসির রানীর জীবনী , আবার কখনো গঙ্গুবাই-এর , সমাজের বিভিন্ন স্তরের ভিন্ন নারী চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অভিনয়ের মাধ্যমে।
বিশ্বে নারীর অধিকার, নারীর শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা সংক্রান্ত প্রচার-প্রসারে প্রত্যহ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। ভারতবর্ষও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। অতি সাম্প্রতিককালে ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় স্তর থেকে নারী শিক্ষার জন্য ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ প্রকল্প, ১৮ বছর বয়সের পর নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য উৎসাহ ভাতা ইত্যাদি উদ্যোগও গৃহীত হয়েছে। সর্বোপরি কথা হচ্ছে সবাই মিলে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়া নারীর অধিকার আদায়ে একজন নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারী স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মতামত প্রদানে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে নারীর ক্ষমতায়নে আর কোনো অপশক্তিই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।